আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন আমাদের ভোটার এলাকা পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে। হতে পারে আপনি পড়াশোনার জন্য অন্য শহরে গিয়েছেন, অথবা নতুন চাকরি আপনার ঠিকানা পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। এমন অবস্থায় স্থান বদলের পাশাপাশি ভোটার তালিকা স্থানান্তর করাটাও জরুরি। তাই, ভোটার এলাকা পরিবর্তন করার নিয়ম কানুন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আর্টিকেলটি বিস্তারিত পড়ুন।
কেন ভোটার এলাকা বদলানো জরুরি?
চলুন আগে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করি যে, ভোটার এলাকা পরিবর্তন কেন দরকার? ধরুন, আপনি এখন ঢাকায় থাকেন, চাকরি করেন বা পড়াশোনা করেন, অথচ আপনার ভোটার এলাকা এখনো রাজশাহীতে। ভোট দিতে হলে কি এখনো এতদূর ছুটে যেতে হবে? বাস্তবে এটা বেশ ঝামেলার, সময়সাপেক্ষও।
আবার অনেক মেয়ের ক্ষেত্রেও বিয়ের পর নতুন ঠিকানায় ভোটার হওয়ার দরকার পড়ে, কারণ আগের এলাকার সঙ্গে আর কোনো সরাসরি যোগাযোগ থাকে না।
এক্ষেত্রে যখন আপনি এনআইডি কার্ডের ঠিকানা পরিবর্তন করেন, তখন সেই সঙ্গে ভোটার এলাকা পরিবর্তন করাটাও দরকার হয়ে পড়ে। এই ব্যাপারটা যদি আগেভাগে জানা থাকে, তাহলে ভোট দেওয়ার অধিকারটা ঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় কোনো বাধা ছাড়াই।
ভোটার এলাকা পরিবর্তন করার নিয়ম
জীবন জীবিকার তাগিদে, লেখাপড়ার জন্য, কিংবা অন্য যেকোনো কারণে আমাদের প্রায়ই এলাকা পরিবর্তন করতে হয়। ফলে, যেখানে ভোটার হয়েছি, সেখান থেকে অন্য ঠিকানায় বসবাস করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে ভোটার এলাকা পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে।
একটা বাস্তব ঘটনা বলি,
কয়েক বছর আগের কথা। ঢাকায় চাকরি পেয়েই হুড়োহুড়ি করে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিয়েছিলাম। নতুন শহর, নতুন ঠিকানা সবকিছুই নতুন ছিল। কিন্তু যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলো, তখন মাথায় হাত!
আমার ভোটার এলাকা তখনো ময়মনসিংহে, যেখানে পৌঁছাতে একদিনই লেগে যায়। অফিস থেকে ছুটি পাওয়া দুষ্কর, তবু ভোট তো দিতে হবে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝলাম, ভোটার এলাকা পরিবর্তন করার নিয়ম জানা না থাকলে ঝামেলা পিছু ছাড়ে না।
তখনই ঠিক করলাম, এই বিষয়ে ভালো করে জেনে নিয়ে এলাকাই বদলে ফেলবো। তখন আমি সেই প্রক্রিয়া নিজে করে দেখেছি, আর এখন চাইছি আপনাকে সহজ ভাষায় পুরোটা বুঝিয়ে দিতে। যাতে আপনার ভোটাধিকার বাস্তবে রূপ পায়, শুধু কাগজে-কলমে না। তাহলে চলুন, দেখে নেয়া যাক কীভাবে সহজেই ভোটার এলাকা পরিবর্তন করা যায়।
ভোটার এলাকা পরিবর্তন করতে কি কি লাগে
ভোটার এলাকা পরিবর্তনের জন্য কিছু জরুরি কাগজপত্র লাগবে। এগুলো আগে থেকে গুছিয়ে রাখলে আপনার কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। ডকুমেন্টস গুলো হলো:
১) NID Form 13 (এটি ভোটার এলাকা পরিবর্তনের মূল ফর্ম)
২) জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি
৩) আপনি যে নতুন এলাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছেন, সেখানকার নাগরিকত্ব সনদ প্রয়োজন হবে। এটি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারেন।
৪) নতুন ঠিকানার স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, ট্যাক্স রশিদ অথবা বাড়ি ভাড়ার চুক্তিপত্র প্রয়োজন হবে।
৫) ফরম-১৩ এর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় আপনার এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা চেয়ারম্যানের NID নম্বর, নাম, স্বাক্ষর ও সিল লাগবে।
যেভাবে ভোটার এলাকা পরিবর্তন ফরম ১৩ পূরণ করবেন
ভোটার এলাকা পরিবর্তনের প্রথম ধাপ হলো NID Form 13 ডাউনলোড করা। এই ফর্মটি নিয়ের দেয়া লিংক থেকে PDF আকারে সহজেই ডাউনলোড করতে পারবেন।
ফর্মটি ডাউনলোড করে প্রিন্ট করুন। ফর্মের প্রতিটি ঘর মনোযোগ দিয়ে পূরণ করুন। কোনো তথ্য ভুল দেওয়া যাবে না। ফর্ম পূরণের সময় আপনার বর্তমান এবং নতুন ঠিকানা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করুন।
ফরম পূরণ এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করার পরে, আপনাকে আবেদন করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আপনার পূরণ করা ফর্ম এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বর্তমান ভোটার এলাকার উপজেলা নির্বাচন অফিসে জমা দিতে হবে।
ভোটার এলাকা পরিবর্তন ফি প্রদান
ভোটার এলাকা পরিবর্তনের জন্য একটি নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করতে হয়। বর্তমানে এই ফি ভ্যাটসহ ২৩০ টাকা। আপনি বিকাশ, রকেট বা অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে এই ফি পরিশোধ করতে পারবেন।
বিকাশের মাধ্যমে পরিশোধ করার নিয়ম
বিকাশ অ্যাপে লগইন করে Pay Bill অপশনে যান। এরপর বিভিন্ন ক্যাটাগরির বিলের তালিকা থেকে Government Fee অপশনটি সিলেক্ট করুন। এবার সেখান থেকে NID Service সিলেক্ট করুন।
আবেদনের ধরণ হিসেবে NID Info Correction নির্বাচন করে NID নম্বর দিয়ে বিল পেমেন্ট সম্পন্ন করুন। পেমেন্ট সফল হলে একটি ডিজিটাল রিসিট পাবেন। এটি সংরক্ষণ করুন, প্রয়োজনে ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।
ভোটার এলাকা পরিবর্তন করতে কতদিন সময় লাগে?
ভোটার এলাকা পরিবর্তন হতে সাধারণত ৭ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। তবে, নির্বাচন অফিসের কার্যক্রমের উপর নির্ভর করে এই সময় কম বেশি হতে পারে।
ভোটার এলাকা পরিবর্তন সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
- নতুন ভোটার আইডি কার্ড
ভোটার এলাকা স্থানান্তরের পর আপনি নতুন ঠিকানার ভোটার আইডি কার্ড পাবেন না। ঠিকানা পরিবর্তনের কারণে সংশোধিত ভোটার আইডি কার্ড দেওয়া হয় না। তবে, যদি আপনার সংশোধিত জাতীয় পরিচয় পত্রের প্রয়োজন হয়, তাহলে NID Reissue Fee পরিশোধ করে রিইস্যুর জন্য আবেদন করতে পারেন।
- অনলাইনে ভোটার এলাকা পরিবর্তন
বর্তমানে অনলাইন ভোটার এলাকা পরিবর্তনের সুযোগ নেই। তবে নির্বাচন কমিশন ভবিষ্যতে এই প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করার জন্য কাজ করছে। এখন পর্যন্ত, সরাসরি উপজেলা নির্বাচন অফিসে গিয়ে আবেদন করাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
ভোটার এলাকা পরিবর্তন করার নিয়ম সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর
১) স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন না করে ভোটার এলাকা পরিবর্তন করা যাবে কি?
হ্যাঁ, স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন না করেও ভোটার এলাকা পরিবর্তন করা যায়। আপনি যেখানে বর্তমানে বসবাস করছেন, সেই ঠিকানার ভিত্তিতে ভোটার এলাকা পরিবর্তন করতে পারবেন।
২) ভোটার এলাকা পরিবর্তনের জন্য কি কি ডকুমেন্টস প্রয়োজন?
ভোটার এলাকা পরিবর্তনের জন্য NID Form 13, জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি, নাগরিকত্ব সনদ, ঠিকানার প্রমাণপত্র (বিদ্যুৎ বিল/পানির বিল/ট্যাক্স রশিদ/বাড়ি ভাড়ার চুক্তিপত্র), এবং শনাক্তকারীর তথ্য (ওয়ার্ড কাউন্সিলর/চেয়ারম্যানের NID নম্বর, নাম, স্বাক্ষর ও সিল) প্রয়োজন হবে।
৩) ভোটার এলাকা পরিবর্তন করার পর নতুন NID Card পাবো তো?
না, ভোটার এলাকা পরিবর্তন করার পর নতুন NID Card দেওয়া হয় না। তবে, আপনি যদি সংশোধিত NID Card পেতে চান, তাহলে NID Reissue-এর জন্য আবেদন করতে পারেন।
৪) ভোটার এলাকা পরিবর্তন করার কত দিন পর আমি ভোট দিতে পারবো?
ভোটার এলাকা পরিবর্তনের আবেদন অনুমোদন হওয়ার পর এবং ভোটার তালিকায় আপনার নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরেই আপনি ভোট দিতে পারবেন।
৫) একাধিকবার ভোটার এলাকা পরিবর্তন করা যায়?
হ্যাঁ, আপনি একাধিকবার ভোটার এলাকা পরিবর্তন করতে পারবেন, যদি আপনার ঠিকানা পরিবর্তিত হয় এবং আপনি প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করেন।
৬) ভোটার এলাকা পরিবর্তন করার সময় কি আমার আগের ভোটার আইডি বাতিল হয়ে যাবে?
হ্যাঁ, ভোটার এলাকা পরিবর্তন করার পর আপনার আগের ভোটার আইডি বাতিল হয়ে যাবে এবং নতুন ভোটার তালিকায় আপনার নাম অন্তর্ভুক্ত হবে।
চূড়ান্ত মন্তব্য
সঠিক নিয়ম অনুসরণ করে সহজেই ভোটার এলাকা পরিবর্তন করা যায়। এই ব্লগ পোস্টে ভোটার এলাকা পরিবর্তনের নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি, এই তথ্যগুলো আপনার কাজে লাগবে।