বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভোটার আইডি কার্ড বা NID কার্ড করার পর সেটা ১বার হলেও সংশোধন করতে হয়। যদিও এর দায়ভার সম্পূর্ণ ডাটা এন্টিকারীদের তবে সেটা যাই হোক, ভুলকে ভুল হিসেবে রেখে দেয়াটাই সবচেয়ে বড় ভুল। তাই NID কার্ডে থাকা সকল ভুল সংশোধন করা জরুরি।
জাতীয় পরিচয়পত্রে নিজের নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ কিংবা যেকোনো তথ্য সংশোধন করতে প্রয়োজন ভ্যালিড ডকুমেন্টস। কিন্তু সকল ভুলের সংশোধনের জন্য তো একই ডকুমেন্টস কার্যকর হবে না। তাই কোন ভুলের জন্য ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন করতে কি কি লাগে সেই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের আলোকে সাজানো হয়েছে এই আর্টিকেলটি। চলুন তবে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন করতে কি কি লাগে?
ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন করতে কি কি লাগে, তা ভুলের ধরনের ওপর নির্ভর করে। আপনি কি পরিবর্তন করবেন তার পেক্ষিতেই বলা সম্ভব যে আপনার কি কি ডকুমেন্টস জমা দিতে হবে। তবে যেকোনো ভুল সংশোধনের আবেদনের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ম ২টি ডকুমেন্টস আপলোড করা জরুরি। এবার প্রচলিত কিছু ভুল এবং সেগুলো সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় যে ডকুমেন্টস সেটি জানানো হলো:
নামের আক্ষরিক সংশোধন
যদি আপনার নামের বানানে সামান্য ভুল থাকে (যেমন “আব্দুর মালেক” এর স্থলে “আব্দুল মালেক” লেখা থাকে) তাহলে নিম্নলিখিত ডকুমেন্টসগুলো প্রয়োজন হবে:
১) এসএসসি সনদ (SSC Certificate): যদি আপনি এসএসসি পাস করে থাকেন, তাহলে আপনার এসএসসি সনদের ফটোকপি জমা দিতে হবে। অন্যথায় আপনি যেকোনো শিক্ষাগত সার্টিফিকেট দেখাতে পারবেন।
২) অনলাইন জন্ম সনদ (Online Birth Certificate): আপনার অনলাইন জন্ম সনদের একটি কপি।
নামের আমূল সংশোধন
যদি নামের বড় ধরনের পরিবর্তন করতে চান, যেমন “সাফিয়া খাতুন” এর স্থলে “মাফিয়া খাতুন” অথবা “আব্দুল মালেক” এর স্থলে “আব্দুল খালেক”, তাহলে নিম্নলিখিত ডকুমেন্টসগুলো লাগবে:
প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট | বিস্তারিত |
এসএসসি সনদ | এসএসসি পাস হলে প্রয়োজন, অষ্টম শ্রেণী বা তার নিচে হলে লাগবে না। |
জন্ম সনদ | জন্ম সনদের একটি কপি প্রদান করতে হবে। |
ম্যাজিস্ট্রেটের হলফনামা | ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক সত্যায়িত হলফনামা। |
জাতীয় দৈনিক পত্রিকা | জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। |
স্ত্রীর NID কার্ড (বিবাহিত হলে) | বিবাহিত হলে স্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত ফটোকপি। |
সন্তানদের NID/জন্ম সনদ ও স্কুলের সনদ (বিবাহিত হলে) | সন্তানের NID/জন্ম সনদ এবং স্কুলের সনদের সত্যায়িত কপি। |
কাবিননামা (বিবাহিত হলে) | বিবাহের প্রমাণ হিসেবে কাবিননামা জমা দিতে হবে। |
পিতার ওয়ারিশ সনদ | পিতার ওয়ারিশ সনদ, যেখানে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর উল্লেখ থাকবে। |
চেয়ারম্যানের সনদ | স্থানীয় চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত একটি সনদ। |
স্বামী/স্ত্রীর নাম সংযোজন
যদি আপনি আপনার ভোটার আইডি কার্ডে স্বামী/স্ত্রীর নাম যোগ করতে চান, তাহলে নিম্নলিখিত ডকুমেন্টসগুলো প্রয়োজন হবে:
- কাবিননামা: বিবাহের প্রমাণ হিসেবে কাবিননামা।
- সন্তানদের জন্ম সনদ: যদি সন্তান থাকে, তবে তাদের জন্ম সনদের কপি। অন্যথায় বাদ।
স্বামী/স্ত্রীর নাম সংশোধন
যদি স্বামী/স্ত্রীর নামে ভুল থাকে, যেমন “আব্দুল খালেক” এর স্থলে “মাসুদ আলম”, তাহলে নিম্নলিখিত ডকুমেন্টসগুলো লাগবে:
প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট | বিস্তারিত |
তালাকনামা/মৃত্যু সনদ | তালাক হলে কাজি কর্তৃক প্রদত্ত তালাকনামা (শালিসের মাধ্যমে তালাক কপি গ্রহণযোগ্য নয়)। স্বামী/স্ত্রীর মৃত্যু হলে মৃত্যু সনদ। |
নতুন বিবাহের কাবিননামা | পুনরায় বিবাহ হয়ে থাকলে নতুন কাবিননামা প্রদান করতে হবে। |
নতুন স্বামী/স্ত্রীর NID কার্ড/পাসপোর্ট কপি | যদি স্বামী/স্ত্রীর নাম সংযোজন না থাকে, তাহলে স্বামী/স্ত্রীকে আবেদন করতে হবে। |
সন্তানদের জন্ম সনদ, স্কুলের সনদ, NID কার্ড কপি | সন্তানের জন্ম সনদ, স্কুলের সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি। |
চেয়ারম্যানের সনদ | চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত সনদ, যেখানে তালাক ও বিবাহের কারণ উল্লেখ থাকবে। |
ম্যাজিস্ট্রেটের হলফনামা ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকার বিজ্ঞপ্তি | যদি স্বামী/স্ত্রীর নাম তালাক বা মৃত্যুর কারণে পরিবর্তন না হয়ে থাকে। |
স্বামী/স্ত্রীর নাম বিয়োজন (বাদ দেয়া)
যদি ভোটার আইডি কার্ড থেকে স্বামী/স্ত্রীর নাম বাদ দিতে চান, তাহলে নিম্নলিখিত ডকুমেন্টস গুলো প্রয়োজন হবে:
- তালাকনামা ও চেয়ারম্যান সনদ
- পুনরায় বিবাহ না করার সনদ।
- পিতার জাতীয় পরিচয়পত্র।
মাতা/পিতার নামের আক্ষরিক সংশোধন
যদি আপনার মাতা/পিতার নামের বানানে সামান্য ভুল থাকে, যেমন “ফাতেমা বেগম” এর স্থলে “ফাতেমা আক্তার” অথবা “ফাতেমা আক্তার চৌধুরী”, তাহলে নিম্নলিখিত ডকুমেন্টস গুলো লাগবে:
- এসএসসি / এইচএসসি সনদ।
- অনলাইন জন্ম সনদ (বাংলা ও ইংরেজি)।
- পিতা-মাতা, ভাই-বোনের NID কার্ড, জন্ম সনদ, শিক্ষা সনদ।
- চেয়ারম্যানের সনদ।
- পেনশন বইয়ের কপি অথবা সার্ভিস বুকের কপি (যদি চাকরিজীবী হন)।
মাতা/পিতার নামের আমূল পরিবর্তন
যদি মাতা/পিতার নামের বড় ধরনের পরিবর্তন করতে চান, তাহলে নিম্নলিখিত ডকুমেন্টস গুলো লাগবে:
- এসএসসি সনদ ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হলফনামা।
- অনলাইন জন্ম সনদ (বাংলা ও ইংরেজি)।
- পিতা-মাতা, ভাই-বোনের – NID কার্ড, জন্ম সনদ, শিক্ষা সনদ।
- চেয়ারম্যানের সনদ।
- পেনশন বইয়ের কপি অথবা সার্ভিস বুকের কপি (যদি চাকরিজীবী হন)।
জন্ম তারিখ সংশোধন
যদি শুধু জন্ম তারিখ সংশোধন করতে হয়, সেক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কন্ডিশন ভিত্তিক ডকুমেন্টস প্রয়োজন:
পার্থক্যের ধরন | প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট |
একই বছরের মধ্যে মাস সংশোধন বা ৯-১০ মাসের পার্থক্য | এসএসসি সনদ ও জন্ম সনদের সত্যায়িত কপি। |
এক বছরের বেশি পার্থক্য | ১. আবেদনকারীর পিতার সকল সন্তানদের জাতীয় পরিচয়পত্র।২. জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর উল্লেখপূর্বক ওয়ারিশ সনদ।৩. এসএসসি সনদের সত্যায়িত কপি।৪. জন্ম সনদের সত্যায়িত কপি।৫. চাকরিজীবী হলে সার্ভিসবুক কপি অথবা পেনশন বুক কপি। |
বাড়ির নাম সংশোধন
- আবেদনকারীর পিতা-মাতা অথবা ভাই-বোনের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি (যে সংশোধনটি চাচ্ছেন, সেটি তাদের আইডি কার্ডে উল্লেখ থাকতে হবে)।
- চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র।
ডাকঘর ও কোড পরিবর্তন
- আবেদনকারীর পিতা-মাতা অথবা ভাই-বোনের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি (যে সংশোধনটি চাচ্ছেন, সেটি তাদের আইডি কার্ডে উল্লেখ থাকতে হবে)।
- চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র।
- পোস্ট মাস্টারের প্রত্যয়নপত্র।
রক্তের গ্রুপ পরিবর্তন
- সরকারি বা বেসরকারি মেডিকেল প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্যাডে ব্লাড টেস্টের কপি।
স্বাক্ষর পরিবর্তন
- পাসপোর্ট কপি, ব্যাংক প্রত্যয়ন কপি, ড্রাইভিং লাইসেন্স কপির মধ্যে যেকোনো একটি।
ব্যাস এটুকুই ছিল সকল তথ্য ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন করার ক্ষেত্রে কি কি লাগবে সেই বিষয়ে।
ভোটার আইডি কার্ড সংশোধনের নিয়ম
ভোটার আইডি কার্ড সংশোধনের জন্য অনলাইনে এবং অফলাইনে দুটো উপায় রয়েছে। নিচে এই দুটি পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:
অনলাইনে ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন
- বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে যান।
- “NID Card Services” অপশনে ক্লিক করুন।
- আপনার NID নম্বর এবং অন্যান্য তথ্য দিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করুন।
- অ্যাকাউন্টে লগইন করে “Edit Profile” অপশনে যান।
- যে তথ্য সংশোধন করতে চান, সেটির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস আপলোড করুন।
- ফর্মটি সাবমিট করুন এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি রেফারেন্স নম্বর সংগ্রহ করুন।
এই বিষয়টি আরো ভালোভাবে বুজতে অনলাইনে ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন করার নিয়ম এর বিস্তারিত আর্টিকেলটি দেখে নিন।
অফলাইনে ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন
- নিকটস্থ নির্বাচন কমিশন অফিসে যান।
- সংশোধন ফর্ম সংগ্রহ করুন।
- ফর্মটি সঠিকভাবে পূরণ করুন এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস সংযুক্ত করুন।
- ফর্মটি জমা দিন এবং একটি প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ সংগ্রহ করুন।
সচরাচর জিজ্ঞাস্য (FAQ)
১) ভোটার আইডি কার্ড সংশোধনের জন্য কত টাকা লাগে?
ভোটার আইডি কার্ড সংশোধনের জন্য ফি সংশোধন ধরনের উপর নির্ভর করে। সাধারণত, প্রথমবার সংশোধনের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি ২৩০ টাকা দিতে হয়। পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয়বার সংশোধন ফি ৩৪৫ টাকা ও তৃতীয়বার ও পরবর্তী সংশোধন ফি ৫৭৫ টাকা।
২) ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন হতে কত দিন লাগে?
ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন হতে সাধারণত ১৫ থেকে ৩০ দিন লাগে।
৩) ভোটার আইডি কার্ড সংশোধনের আবেদন বাতিল হলে কি করব?
যদি আপনার আবেদন বাতিল হয়, তাহলে বাতিলের কারণ জানতে নির্বাচন কমিশন অফিসে যোগাযোগ করুন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পুনরায় জমা দিয়ে আবার আবেদন করতে পারেন।
৪) ভোটার আইডি কার্ডের ভুল সংশোধন না করলে কি সমস্যা হতে পারে?
ভোটার আইডি কার্ডের ভুল সংশোধন না করলে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সেবা গ্রহণ করতে পারবেন না। এছাড়া, আপনার নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি করবে।
৫) ভোটার আইডি কার্ডে ছবি পরিবর্তন করার নিয়ম কি?
ভোটার আইডি কার্ডে ছবি পরিবর্তন করার জন্য নির্বাচন কমিশন অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। ছবি পরিবর্তনের জন্য নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করে স্পেসিফিক নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে।
চুড়ান্ত মন্তব্য
ভোটার আইডি কার্ডে ভুল যতটাই ক্ষুদ্র হোক না কেনো, সংশোধন করে নেয়াটা জরুরি। এই আর্টিকেলে ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন করতে কি কি লাগে এবং কিভাবে সংশোধন করতে হয়, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করছি উক্ত আর্টিকেলটি আপনার NID কার্ড সংশোধন করার ধাপকে আর সহজ করবে।